Header Ads

নরসিংদীর কলার খ্যাতি দেশজোড়া


দেশের বিভিন্ন এলাকায় যাচ্ছে নরসিংদীর সাগর কলা। এককালে দেশি সাগর কলার ঐতিহ্য থাকলেও এখন এর স্থান দখল করছে নেপালি সাগর কলা। নগরায়ণ, অপরিকল্পিত চাষাবাদ, সার-কীটনাশকের মূল্যবৃদ্ধি, রাসায়নিক সার প্রয়োগের ফলে জমির গুণাগুণ নষ্ট হয়ে যাওয়ায় কলা চাষে কিছুটা ভাটা পড়লেও বহু পরিবার এখনও কলা চাষের ওপরই জীবিকা নির্বাহ করে। নরসিংদীর সাগর কলার ঐতিহ্য ধরে রাখতে নিবিড় গবেষণার মাধ্যমে দেশি জাতের সাগর কলার উচ্চ ফলনশীল জাত উদ্ভাবনের দাবি কৃষকদের।

কলা চাষিরা জানান, নরসিংদীতে দেশি জাতের সুস্বাদু সুগন্ধি সাগর কলার উৎপাদন কমে গেছে আশঙ্কাজনকভাবে। সেই স্থান দখল করছে নেপালি সাগর কলা। কোনো কোনো এলাকায় চাষাবাদ হচ্ছে চম্পা ও সবরি কলা। কিন্তু এসব জাতের কলা চাষ করে চাষিরা দেশি সাগর কলার মতো ভালো উৎপাদন পাচ্ছেন না। এ কারণে তারা হতাশ। তারপরও দীর্ঘদিন ধরে কলা আবাদের সঙ্গে জড়িত চাষিরা কলা উৎপাদনের ওপরই নির্ভরশীল।

নরসিংদীর কৃষি বিভাগের তথ্য মতে, জেলার মাত্র এক হাজার ৩৫০ একর জমিতে কলা চাষাবাদ হচ্ছে। এতে দেশি জাতের সাগর কলা একেবারেই কম। আবাদকৃত কলার মধ্যে বেশির ভাগই নেপালি সাগর কলা। এর পরের অবস্থানে রয়েছে চম্পা, সবরি, কবরি ইত্যাদি কলা। তবে এক সময় জেলায় আরও বেশি পরিমাণ জমিতে কলা আবাদ হতো। চাষিরাও আরও বেশি লাভবান হতেন। মাটির গুণাগুণ বিনষ্টের কারণেই দেশি জাতের কলা চাষাবাদের এলাকা দিন দিন সঙ্কুচিত হয়ে পড়ছে বলে অভিমত কৃষি বিভাগের।

চাষিরা জানান, কলা চাষের জন্য বেলে দোআঁশ মাটির প্রয়োজন হলেও তা এখন আর নেই। অতিমাত্রায় রাসায়নিক সার ব্যবহারের ফলে মাটি শক্ত হয়ে যাওয়ায় দেশি জাতের সাগর কলা চাষাবাদ করা যাচ্ছে না। দেশি সাগর কলা রোপণ করলে গাছ বড় হয় না। আবার গাছ হলেও কলার ছড়িতেও কাঁদি বেশি জন্মে না। কলার আকারও অনেক ছোট হয়। মাটির কারণে কলার ছড়িতে রোগের প্রাদুর্ভাব বেশি দেখা দেয়। এ কারণে অনেক চাষি দেশি সাগর কলা চাষাবাদ বন্ধ করে চম্পা, সবরি ও গেরা (বাংলা) কলা চাষের পর এখন নেপালি সাগর কলার চাষাবাদ করছেন।

সূত্র জানায়, ব্রিটিশ শাসনামলের প্রথম দিকে নরসিংদী জেলার ৬টি উপজেলায় প্রায় ৪ হাজার হেক্টর জমিতে কলা চাষাবাদ হতো। তার মধ্যে অন্তত ৩ হাজার হেক্টরে চাষাবাদ হতো সবরি, কবরি, চাম্পা, চিনি চম্পা, অগ্নিসাগর ইত্যাদি। এই পরিমাণ জমিতে ৮০ টন কলা উৎপাদন হতো। ওই সময় কলা আবাদ ও ব্যবসার সঙ্গে জড়িত ছিলেন এক থেকে দেড় লাখ মানুষ। ভূতত্ত্ববিদদের মতে, কলার উৎপত্তিস্থল যেহেতু এশিয়া সেহেতু কৃষির প্রারম্ভিকতা থেকেই সম্ভবত নরসিংদীতে কলার চাষাবাদ হতো। কৃষিতাত্ত্বিকদের মতে, ধান চাষাবাদের সমসাময়িক কাল থেকে নরসিংদীতে কলা চাষাবাদ হয়ে থাকতে পারে।

চাষিরা জানান, নরসিংদীর মানুষ পাহাড়ি ও সমতল ভূমিতে কলা চাষ করত। সবচেয়ে বেশি চাষ হতো মনোহরদী উপজেলায়। সেখানকার কলা বেচাকেনার জন্য চালাকচর, সাগরদী, মনোহরদী, হাতিরদিয়াসহ কয়েকটি বাজারে শত শত টন কলা আমদানি হতো। এসব বাজার থেকে ট্রাক ভর্তি কলা যেত ঢাকাসহ দেশের বিভিন্ন স্থানে। পলাশের চরসিন্দুর, গজারিয়া, তালতলী, পারুলিয়া, কালির বাজার, রাবান বাজার, চরনগরদী, নরসিংদীর ভাটপাড়া, শীলমান্দী, শিবপুরের ফতেপুর, সিঅ্যান্ডবি, পালপাড়া ইত্যাদি বাজারে হাজার হাজার টন কলা আমদানি হতো। আর এসব বাজার থেকে ট্রাক ভর্তি করে কলা যেত দেশের বিভিন্ন স্থানে।

কলা ব্যবসায়ী ও চাষিদের দেয়া তথ্য অনুযায়ী, নরসিংদী থেকে রাজধানী ঢাকা ও সেখান থেকে দেশের বিভিন্ন স্থানে রফতানি করা হতো কলা। কলা রফতানির জন্য পাকিস্তান শাসনামলে বাংলাদেশের রেলওয়ের একটি লোকাল ট্রেনের নামকরণ করা হয়েছিল কলার গাড়ি। প্রতিদিন বিকেলে নরসিংদী জেলার দৌলতকান্দী, শ্রীনিধি, মেথিকান্দা, খানাবাড়ী, আমীরগঞ্জ, নরসিংদী, জিনারদি, ঘোড়াশাল ইত্যাদি রেলস্টেশনে হাজার হাজার টুকরি কলা জমা হতো। সন্ধ্যার পর কলার গাড়িতে তুলে এসব কলা রাজধানী ঢাকাসহ দেশের বিভিন্ন স্থানে পাঠানো হতো। এ ছাড়াও ঢাকা-চট্টগ্রাম ও ঢাকা-সিলেট রেললাইনে চলাচলকারী প্রতিটি ট্রেনেই কলার বগি থাকত। পাকা কলার টুকরি নিয়ে প্রতিদিন শত শত হকার বিভিন্ন ট্রেনে নরসিংদীর কলা বিক্রি করত।

স্থানীয় লোকজনের মতে, ঢাকার নবাবদের প্রাত্যহিক খাদ্য তালিকায় নরসিংদীর কলা ছিল অত্যাবশ্যকীয়। নবাবরা মূলত কাশ্মীরি বংশোদ্ভূত বলে তারা ফল বেশি ভালোবাসত। নরসিংদীর কলার স্বাদ, গন্ধ, রঙ ও আকারে সুন্দর ছিল বলে তারা প্রাত্যহিক খাদ্য তালিকায় কলাকে বেছে নিয়েছিল। এর আগে ঢাকায় নিযুক্ত ২৯ জন মোঘল সুবেদার, ৪৮ জন ইংরেজ লর্ডসহ পাকিস্তান ও বাংলাদেশের শাসকদের জন্য নরসিংদীর কলা সরবরাহ করা হতো। শুধু তাই নয়, রাষ্ট্রীয় অতিথিদেরও নরসিংদীর সাগর কলা দিয়ে আপ্যায়ন করা হতো।

No comments

Powered by Blogger.